সুবর্ণযাত্রার শুরুটা আমরা ঠিক করেছিলাম অক্টোবর এর ১২ তারিখ, ২০২১ , নরওয়ে এর নর্থক্যাপ থেকে। এটা ইউরোপের একেবারে উপর বা নর্থ এর শেষ ভূমি আর এখানেই মিডনাইট সান আর অরোরা বরালিজ অর্থাৎ নর্থয়ার্ন লাইট দেখা যায়। আরো অনেক বিশেষ কারণে নর্থক্যাপ একটি পপুলার ডেস্টিনেশন পয়েন্ট, কিন্তু ওই আলাপে আর যাবো না। আমি কিভাবে সেখানে গেলাম, কি করলাম, কে কে সাথে ছিল – সেই গল্পই বলি ।

আমি থাকি টরন্টো – কানাডায় আর এখন থেকে সরাসরি নর্থক্যাপ ফ্লাই করে যাওয়ার উপায় নাই। থাকলেও হয়তো অনেকগুলি ফ্লাইট নিয়ে, ভেঙে ভেঙে যেতে হয় – কিন্তু যেহেতু এই যাওয়া সুবর্ণযাত্রার জন্য আর আমাদের বেস হচ্ছে ফিনল্যান্ডের রোভেনামি, তাই আমি অক্টোবর এর ৯ তারিখ সন্ধ্যায় টরন্টো থেকে হিথরো এয়ারপোর্ট, লন্ডন এর যাত্রা আরম্ভ করি। শেষ মুহূর্তে বন্ধু শাকিল, ৯৭/৯৯ কানাডিয়ান গ্রুপ এর অন্যতম সদস্য, চলে আসলো সাহাজ্যের হাত বাড়িয়ে – আমাকে বাসা থেকে এয়ারপোর্ট ড্রপ করার জন্য। একটা বড়ো লাগেজ আর কাঁধের ব্যাগপ্যাক গাড়িতে উঠিয়ে কিছুক্ষন সময় লাগলো পরিবার থেকে বিদায় নিতে। হা, অনেক আগে থেকেই এই পরিকল্পনা – সুবর্ণযাত্রার – অনেক অনেক সময়, শ্রম দিয়ে একটু একটু করে প্ল্যান আর প্রিপারেশন, একদম শেষ মুহূর্তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের অংশগ্রহণের দ্বিধা, আবহাওয়ার পরিবর্তন – আর উদ্দীপনায় একটু যেন ভাটা; অজানা আশঙ্কা ভয়ের কিংবা বন্ধুদের সাথে অনেক দিন পর দেখা অথবা এডভেন্ট্রাস একটা জার্নি – এড্রেনালিন দাপিয়ে দুই সপ্তাহ পরিবার থেকে দূরে থাকার ভাবনা – সব যেন থমকে গিয়েছিলো শেষ কয়েক ঘন্টা। 

শাকিল আমাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথেই শুরু হয় বৃস্টি – অঝোর ধারায় । পুরোটা পথ সুবর্ণযাত্রার গানগুলি শুনতে শুনতে এয়ারপোর্ট পৌঁছে কাউন্টার এ যেয়ে ফ্লাইট এর ডিলে নিয়ে আরেকটু চিন্তায় পরে যাই আমি। এখানে বলে রাখি – আমার অনেক গুলা ডট কানেক্ট করার দরকার ছিল – পুরো ২ সপ্তাহ জুড়েই। 

প্রথমেই টরন্টো থেকে এই ফ্লাইট নিয়ে লন্ডন পৌঁছে ২ ঘন্টা পরের ফ্লাইট এ হেলসিংকি যাওয়ার প্ল্যান, যে ফ্লাইট এ আমার সাথে রক্তিম ও লেলিন জয়েন করবে। শুধু তাই নয়, সুইডেন এর স্টোকহোম থেকে কাজী চয়ন ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে, ১২ ঘন্টা ড্রাইভে প্রায় একই সময় হেলসিংকি এয়ারপোর্ট পৌঁছাবে। সেখানেই আমরা ৪ জন একসাথে দুপুর ১২ টা নাগাদ ওই গাড়িতে করে রওনা দিবো রোভেনামি, আমাদের বেস স্টেশনে, যেখানে মতিউর আমাদের পিজিয়ন গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত। সেখানেই, পরদিন সকাল ৯টায় শুভযাত্রার টীম আর মাশা ইসলাম এর সাথে আমাদের টাইটেল সং এর মিউজিক প্রিমিয়ার শেষ করে ১টায় নর্থক্যাপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর প্ল্যান। ইতিমধ্যে লাস ভেগাস এ ৫ দিনের অফিসিয়াল কনফারেন্স শেষ করে মাত্র ১ দিনের জন্য বাসায় ফিরে, সন্ধ্যায় লোকাল এমপি নাথানিয়াল থেকে সুবর্ণযাত্রার জন্য কিছু পেপারস কালেক্ট করা হয়ে গেছে। বেশ কিছু লেটার আর গিফট-আইটেম গুলা আমার কাঁধের ব্যাগপ্যাকেই আছে। কনফারেন্স আর ফ্লাইট এর ক্লান্তি এর সাথে জেটল্যাগ আর সুবর্ণযাত্রার স্বপ্ন পূরণ এ আরেকটা ডট কানেক্ট করার জন্য – আবার শুরু হলো এডহক টিম রিসার্চ।

লন্ডন ল্যান্ড করার পর হাত এ থাকলো আমার মাত্র ৩০ মিনিট যা কখনোই আমাকে পরবর্তী ফ্লাইট ধরার জন্য যথেষ্ট নয়। প্লেন হিত্রো এয়ারপোর্ট এ ল্যান্ড করে টাক্সিং করে যখন গেট এর দিকে যাচ্ছিলো, আমি তখন সুমন, আদনান, লেলিন, রক্তিম এর মেসেজ গুলা পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম – হেলসিংকি এর এই ফ্লাইট আমি ধরছি না। যদিও লেলিন আর রক্তিম ‘৩ ইডিয়ট’ এর মতো কিছু একটা করতে চাচ্ছিলো যাতে ফ্লাইট একটু ডিলে হয়, কিন্তু হয়তো সুমন এর সাথে দেখা করার, কিংবা লন্ডনের সেই বিখ্যাত চিকেন উইংস খাবার লোভ আমাকে লন্ডন থেকে যাওয়ার জন্য বলছে – তাই আর অঘটন কিছু ঘটালাম না আমরা। আসলে, যখন ২ ঘন্টা লেট্ হলো টরন্টো এয়ারপোর্ট এ, তখনি বের হয়েছিল আরেকটি সমীকরণ। না, আমি কোনোভাবেই সুবর্ণযাত্রার অভিযান শুরুটা পেছাতে পারবো না, কারণ শুধু আমি না – শুভ, মাশাদের প্রোগ্রাম ছাড়াও, সি আর ডি এর রাজিব বেশ কিছু সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে আর জন, মিতা, নাহিদ, যুথি, হ্যাপি, অন্তু করিম প্রিপারেশন নিচ্ছে মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে কেক কাটার জন্য। তাই, আমাদের সমীকরণটা ছিল লন্ডন থেকে হেলসিংকির পরবর্তী ফ্লাইট আমি নেবো বিকেল ৬টায়, সেই ফ্লাইট রাত ১০:৩০ এ পৌঁছাবে, আর ঠিক ৪৫ মিনিট পর ১১:১৫ এর ফ্লাইট নিয়ে ওলু পৌছাবো আমি রাত ১টা নাগাদ, হেলসিংকি থেকে ৬০০ কিমি দূরের এক শহর । কিন্তু আমি রোভেনামি যাবো কিভাবে? ওলু থেকে তো তখনও আমি প্রায় ২০০ কিমি দূরে। আর চয়ন, লেলিন, রক্তিম? হা, ওদের সাথেই হেলসিংকি থেকে আমার রওনা করার কথা ছিল, আর খানিকটা ওলু এর পথ ধরেই রোভেনামি যেতে হয় – তাই, ওদেরকেই একটু লেট করে রওনা দিয়ে ওলু থেকে আমাকে তুলে নিতে বলা হলো। টরন্টো এয়ারপোর্টে বসে এই প্ল্যান বি টা ঘষামাজা করা হলো। আর টার্মিনাল এ বসে ওই সময় আমার হাত এ ‘সুবর্ণযাত্রা’ টাইটেল সং এর ভিডিও টাও এসে পৌছালো। এতো অদ্ভুত ভালো লাগা ভর করেছিল তখন, ভিডিও দেখে, যা বলে বোঝানো অসম্ভব। তৎক্ষণাৎ বসে আমি ভিডিও টা ইউটুবে প্রিমিয়ারে দিয়ে দিলাম, ৩০ঘন্টা পর পাবলিক লঞ্চ হবে, আমাদের টীম তখন লাইভ অনুষ্ঠানও করবে। ভিডিওটা দেখতে দেখতে মনে হলো – এতো কষ্টের পর যদি শুরুটা ঠিকমতো না করতে পারি, পারিপার্শ্বিকতার কারণে, চেষ্টা তো করতে পারি শতভাগ – আর মনেই হচ্ছিলো প্ল্যান এ হোক আর বি – বেবস্থা হয়েই যাবে একটা, এতগুলা মানুষের স্বপ্ন এই সুবর্ণযাত্রা। 

হিত্রোতে প্লেন গেট এ আসার আগেই আমি একমাত্র মেসেজ দিলাম আমাদের গ্রুপে – ‘একটিভেট প্ল্যান বি’। সময় ছিল খুবই কম আর এই সময় কথা বলার সুযোগ করা কঠিন ছিল আমাদের । আমি প্লেন এর ভিতর মাস্ক পড়া, লেলিন আর রক্তিম ফিন এয়ার এর গেট এ সিকিউরিটি চেকিং এ। বাকি অনেকের মাঝেই উৎকণ্ঠা, আবেগ আর ঝড় আসার পূর্ববর্তী শিথিলতা। রোভেনামি থেকে নর্থক্যাপ আরো ৭০০ কিমি দূরে – পারবে তো টিমের সবাই পিজিওন নিয়ে পৌঁছাতে? এতো বড়ো একটা পদক্ষেপ নিলাম কি করে আমরা? গত ৬-৭ মাস কত কত সময় দিয়েছি আমরা এই অভিযাত্রার পিছনে, প্ল্যানিং আর প্রিপারেশনে। ওই ৫/৬ জন সময়মতো লাইভ এ এসে গাড়ি নিয়ে বলতে পারবে তো “হ্যাপি বার্থডে বাংলাদেশ, উই আর লাইভ ফ্রম নর্থক্যাপ – স্টার্টিং আওয়ার জার্নি টুওয়ার্ডস বাংলাদেশ – ৫০ কান্ট্রিস, ৪০,০০০+ কিমি জার্নি বিগিন্স টুডে, অক্টোবর ১২, ২০২১। “

একটু সুবর্ণযাত্রাটা কি বলি? নরওয়ে থেকে মোটরযানযোগে যাত্রা করে পৃথিবীর ৫০টি দেশের প্রায় ৪০,০০০ কি. মি. পথ পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশে পৌঁছাবে অভিযাত্রী দল | এই যাত্রায় বাংলাদেশের অর্জন পৌঁছে যাবে বিশ্ব মানচিত্রে | পৃথিবী দেখবে কি করে একটি তর্জনীর ইশারায় পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে, ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে | ইউরোপের শেষমাথায়, শুরুর ভূমি থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ পর্যন্ত যাওয়ার দুঃসাহসিক উদ্দ্যোগের নামই হচ্ছে “সুবর্ণযাত্রা”! যেখানে অতিক্রান্ত শহরগুলোতে সফল বাংলাদেশের ইতিবৃত্য উপস্থাপণের পাশাপাশি সারাবিশ্বের শান্তিকামী মানুষের প্রধান চাওয়া, “যুদ্ধ নয় শান্তি” শ্লোগানকেও তুলে ধরা হবে এবং পরবর্তী প্রযন্মের কাছে বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়ার জন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষারও আহ্বাণ জানানো । এই ৩টি থিম এর উপর ভর করে, ৯৭/৯৯ ব্যাচ এর বন্ধুদের নিঃস্বার্থ অংশগ্রহণে আমাদের যাত্রা – সুবর্ণযাত্রা। 

হিত্রো এয়ারপোর্ট এর বাইরে যখন আমি আসি, ততক্ষনে ফিন এয়ার আকাশ এ উড়াল দিয়েছে লেলিন আর রক্তিমকে নিয়। খুব একটা ফোনের দিকে তাকালাম না – দেখতে থাকলাম লন্ডন শহর, আমার ইউনিভার্সিটি এখানেই – ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে প্রায় ৪ বছর ছিলাম আমি এই শহরে। কত স্মৃতি আর গল্প এই শহরেই – আর এই হিত্রো এয়ারপোর্ট এ কতবারযে আসাযাওয়া হয়েছে, তার হিসেব আমার জানা নেই। বেশিক্ষন লাগলো না, বাংলাদেশী (সিলেটি) চোখে পড়লো – আমিও এগিয়ে গেলাম বুঝতে পেরে যে কোনো সমস্যা হয়েছে হয়তো। কোনো দ্বিধা না করেই, সিলেটি ভাষায় বলে ফেললেন মদ্ধবয়ষ্ক লোকটি, “ক্রেডিট কার্ড আসে নি তুমার কাসে? আমার কাসে ক্যাশ কিন্তু এই মেশিনও ক্যাশ লয় না। ” আমিও মুচকি হেসে ৫ পাউন্ড এর বিনিময়ে তার কাজটি সেরে দিলাম। চোখ বন্ধ করে, কানে ‘বন্ধু’ গানটি শুনতে শুনতে, মাটিতে বসেই অপেক্ষা করছিলাম, তখনি এলো সুমন এর ফোন। 

আমার এই প্ল্যান বি কিন্তু কাজ করতো না হয়তো যদি সুমন তখন লন্ডন না থাকতো। আমি ভেগাস থেকে যখন টিকেট কেটে কনফার্ম করি লেলিন আর রক্তিম এর সাথে – তখনি সুমন এর একটা ইমার্জেন্সি কারণে আমাদের সাথে জয়েন করতে না পারাটা একটু বিচলিত করে আমাদের সবাইকে । ও যাত্রা শুরুতে আমার সাথে থাকতে পারবে না – এটা ছিল সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা আমার জন্য। সেই স্কুল থেকে, কলেজ, ইউনিভার্সিটি তারপর লন্ডন কিংবা কানাডা আমেরিকা – অলমোস্ট সব টুরগুলাতেই আমরা একসাথে ছিলাম। আর এটা তো সুবর্ণযাত্রা । যাইহোক, হসপিটালে বসেই প্ল্যান বি এক্সেকিউট করে, ওর মেয়ে, মারজান কে নিয়ে চলে এলো আমাকে পিক করতে হিত্রো। সেখান থেকে সরাসরি আমরা গেলাম চিকেন উইংস খেতে। বিকেল পর্যন্ত একসাথে গল্প গুজব করে আর সুবর্ণযাত্রার প্ল্যান এর খুঁটিনাটি নিয়ে আলাপ করলাম আমরা। হিত্রো নামিয়ে দিয়ে ও বলেছিলো – হাসপাতাল থেকে ওর ছোট ছেলে, আরহামকে রিলিজ দিয়ে দিলেই ও চলে আসবে আমাদের সাথে জয়েন করবে। আমি জানি ও আসবে – প্রথম সুযোগ পেলেই আসবে !

ফিন এয়ার এ যাত্রা শুরুর পরেই দেখলাম, ফ্রি-ওয়াইফাই, প্রতি ডিভাইস এর জন্য ১ ঘন্টা করে। আর কি – ল্যাপটপ, ফোন, ট্যাবলেট নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম – নীলার খবর নিলাম সবার প্রথমে। আগে বলিনি, নীলা হচ্ছে আমাদের ভাড়া করা গাড়িটা – চয়ন, লেলিন আর রক্তিম যেটা করে হেলসিংকি থেকে আসছে আমায় পিক করতে, ভক্সওয়াগন এর নীল রং এর গাড়িটার ছদ্দনাম – নীলা। মতিউর কন্ফার্ম করলো – আমাদের জন্য রোভেনামি তে কটেজ রেডি, আর ওখানেই ও আসবে সকাল এ আমাদের মোটরহম করে (পিজিওন যার ছদ্দনাম), আর তারপর আমরা নর্থক্যাপের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করবো। ইমন মালয়েশিয়া থেকে আমাদের একটা ট্রেইলার রেডি করে দিলো – যা ফেইসবুকএ শেয়ার করলাম। বাংলাদেশের জন, কামরুলদের সাথেও আলাপ করে আশ্বস্ত করলাম “স্টিক তো ইওর প্ল্যান, ইনশাল্লাহ, উই শাল ওভারকাম”।  

হেলসিংকিতে ইম্মিগ্রাশন করতে হলো আমার – আর রাত হলেও, বেশ ব্যাস্ত ছিল এয়ারপোর্ট। সবাই পরে ছিল মাস্ক আর একেকজন একেকটা কান্নেক্টরিং ফ্লাইট ধরার জন্য তাড়াহুড়া করে হাটছিলো । চেকিং এর সময় আমার কভীদ-১৯ এর ভ্যাকসিন পেপার্স দেখাতে হলো। খুব একটা সমস্যা হলো না পরের ফ্লাইট ধরতে, কিন্তু যখন বাস এ করে টার্মিনাল থেকে রানওয়ে তে নামিয়ে দিলো আমাদের ১২জন কে – বিমান এর আকার দেখে আমি একটু থমকে গিয়েছিলাম। ওই ১২ জনকে নিয়েই ছোট্ট একটা বিমান উড়াল দিবে, হেলসিংকি থেকে ওলু এর পথ। নাহ, বৃষ্টি আর হচ্ছে না এদিকটায়। 

ওলু এয়ারপোর্টটা খুবই ছোট। প্লেন এর সিঁড়ি দিয়ে নামতে যেয়েই ঠান্ডা বাতাস এর ঝাপ্টা এসে লাগলো মুখে – কেমন জানি লাগলো, অপরিচিত একটা শহর, প্রথমবারে মতো একটা নতুন দেশ এর সাথে আমার পরিচিতি নেই বলেই কি? সবাই যখন একে একে নেমে, যার যার লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে গেলো, পুরা এয়ারপোর্ট এ আমি তখন একা; নীলাকে নিয়ে এখনো ওরা প্রায় ২০মিনিট দূর। ভেবে দেখলাম, প্রায় ৩০ ঘন্টার বেশি আমি রাস্তায়, কিংবা আকাশে, একই কাপড়ে – অল্প একটু ঘুমিয়েছিলাম টরন্টো থেকে হিত্রো আসার পথে। এখনো ঘুম নেই, ক্লান্ত একটু, কিন্তু দুচোখ তাকিয়ে আছে এয়ারপোর্ট এন্ট্রান্সের রাস্তায়। এইতো হয়তো নীলার চোখ দেখা যাবে। সাথে থাকবে আমার বন্ধুরা – অনেকদিন দেখা হয় নি, কি বলবো? আমাদের সুবর্ণযাত্রার গানটির সেই লাইন? “কোথা ছিলি তুই?” 

তখনি মনে হলো, আরে আমার কাছে ল্যাপটপ, স্পিকার আছে – আছে এয়ারপোর্ট এর ফ্রি ইন্টারনেট আর ৮ঘন্টা পর মুক্তির অপেক্ষায় আমাদের সুবর্ণযাত্রার টাইটেল সং। আর দেরি না করে, ল্যাপটপ বের করে সবকিছু কানেক্ট করে জোরে জোরে ছেড়ে দিলাম শুভযাত্রার মিউসিক ভিডিও “ওহ, মাই ল্যান্ড।” ইউরোপের ওলুর ছোট্ট ওই এয়ারপোর্টে হাই ভলিউমএ সুবর্ণযাত্রার টাইটেল সংটি প্রথমবারের মতো বেজে উঠলো। আমিও হেরে গলায় তাল মিলালাম গানটির সাথে, জোরে জোরে। ২ বার বাজতে না বাজতেই দেখলাম বন্ধুদের, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে আসছে, গাড়ি থেকে মাথা বের করে দিয়ে। যদিও কাকপক্ষীও ছিল না আমরা ছাড়া ওই সময়টায়। ওদের সাথে কুশল বিনিময় হলো, হালকা হাঁটাচলা করে, স্যান্ডউইচ খেয়ে আর বন্ধুদের সাথে ভিডিও কল করে অসস্ত করে আমরা রওনা দিলাম আনুমানিক রাত ২ টায়, আমাদের গন্তব্যস্থল – রোভেনামিয়ে। গানটি তখনও বেজে চলছে, গাড়ির স্পিকার থেকে “বিল্ড এ বেটার ওয়ার্ল্ড। ” 

চয়ন আর আমি গাড়ি চালালাম ওলু থেকে প্রায় ৪ ঘন্টার পথ। পথে গ্যাস নিতে আর একবার কিছু নাস্তা কিনতে একটা সার্কেল কে তে থেমেছিলাম আমরা। মাঝরাতেও বেকারি থেকে সুন্দর ঘ্রান আসছিলো, আমরা কিছু ক্রসান্ট আর কুকিজ নিলাম । ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়বো, কিন্তু শত ক্লান্তিতেও ওই ৪ ঘন্টার পথ আমরা সবাই জেগে ছিলাম। দেশে বিদেশে ফোনে কথা হচ্ছিলো, নিজেদের মাঝে একটু খুনসুটি আর সুবর্ণযাত্রার অদ্ভুত শুরুর অপেক্ষা। 

রোভেনামির কটেজ এ যখন আমরা পৌঁছাই, তখন সূর্যোদ্বয় প্রায় হয় হয় । সবাই একে একে হাতমুখ ধুয়ে, গোসল করে, একটু খেয়ে ঘুমাতে গেল। আমার বোধয় তখনি একটু ক্লান্ত অনুভূত হচ্ছিলো, কিন্তু আর ঘন্টাখানেক পরেই আমাদের লাইভ শো। তাই আদনান এর সাথে বসে ফাইনাল খুঁটিনাটি নিয়ে আলাপ করে ব্যাকস্টেজে থেকে শোটা করলাম আমি। আদনান বরাবরের মতোই খুবই সুন্দর সঞ্চালনা করলো, সাথে পলক, মাশা, তমাল, আমজাদ, কামরুল আর শুভ। সুন্দর একটা অনুষ্টান হলো – সবাই বললো কেন তারা সুবর্ণযাত্রার সাথে এই গানটি করেছেন আর গানটি শোনা আর দেখার পর কেমন লাগছে! ওই অনুষ্ঠানটা করা হয়েছিল যেন মাঝামাঝি সময়ে গানটি ইউটুবে প্রিমিয়ারে লাইভ এ যায়। টরোন্টোর এয়ারপোর্টে বসে এই টাইমটাই সেট করেছিলাম। উফফ সব কি সুন্দর মিলে যাচ্ছে। সবাই একসাথে লাইভ মিউসিক ভিডিও দেখে সত্যিই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল । আর যখন আদনান বললো সবাইকে, আমরা সবাই রোভেনামি পৌঁছে গেছি, আরেকটু পরেই নর্থক্যাপ যাবো, আর ৪০০০০+ কিমি যাত্রা আরম্ভ করবো, সবাই একে একে আমাদের নিরাপদ আর সুস্থতা কামনা করলেন। শুভ ওর অফিস এর ফাঁকে অনুষ্টানে এসে শুধু আমরা যারা ভলান্টিয়ার আছি, তাদের না – যারা পরে শুনবে, তারাও যেন এই উদ্যোগএর সাথে একাত্মতা দেখিয়ে সাথে থাকে – এইরকম কিছু বলেছিলো। সবার চোখেমুখে তখন আলোর ঝলক, স্পষ্ট ছিল – মনে যত দুশ্চিন্তা ছিল, সেগুলি আর নেই। গাড়ি আর অভিযাত্রীরা সবাই একসাথে, একই শহরে – আর মাত্র ২৪ঘন্টা । আমজাদ, মাশা, পলক, তমাল সবাই একই সুরে বললো যে, বিদেশে বসে বাংলাদেশিরা সুবর্ণজয়ন্তীতে এমন একটা দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করছে – ব্যাস, এইটুকুই তাদের কে ট্রিগার করেছে গানটা করতে। আর কামরুল? আমাদের সুবর্ণযাত্রার জন্য করা ৪টি গান, ব্লগ, প্রপোসাল রাইটিং, ফেইসবুক পোস্টিং, এডিটিং, বাংলা আর ইংলিশ কনটেন্ট – সবই মোটামুটি এই ছেলেটি, শরীয়তপুরবাসি হাজি শরীয়তুল্লাহ কলেজের ইংলিশ টিচার, কামরুল, আমাদের মাস্টার এর হাত ধরে।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ঘন্টা ৩ এর মতো, মিউসিক প্রিমিয়ার শেষ করেই । মতিউরের আওয়াজ এ ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে, সেই পরিচিত মুখটি দেখে বলেই ফেলেছিলাম ‘কিরে মতি, শীষ দে” । প্রায় ২০ বছর পর থেকে আমাদের, সেই স্কুল আর কলেজের ভাবনাগুলো মাথায় আসার আগেই দেখলাম রক্তিম, লেলিন রেডি হয়ে গেছে। মনে পড়লো তখনি, আমাদের তো নর্থক্যাপ যাত্রা আরম্ভ করতে হবে। আস্তে আস্তে ঘুমের ঘোর কাটতে কাটতে মনে পরে গেলো সবকিছু। প্রায় ৪০ঘন্টা পেরিয়ে গেছে আমি টরন্টো ছেড়েছি। গত ৩দিনে আমার প্রায় ১০,০০০ কিমি পথ পারি দেয়া হয়েছে। অবশেষে সবাই একসাথে একই ছাদের নিচে বসে আছি। “মতি, গাড়ি কই”, আমার প্রশ্নের উত্তরে চিরাচরিত মুচকি হেসে ও বললো, “চল, বাইরে তোদের জন্য অপেক্ষা করছে পিজিওন, একটা ভিডিও কল করে দেশের সবাইকে জানিয়ে দে, রওনা দিবো আমরা ঘন্টাখানিক পর।” 

মতিউরের বাসায় আমরা খিচুড়ি মাংস খেয়ে প্রস্তুত হয়ে গেলাম যাত্রা শুরুর। রিংকু, রোভেনামিয়েতেই থাকে – আমাদের সাথে সময় দিলো – নিয়ে গেলো সান্তা ক্লোসের ভিলেজে । এখানেই পৃথিবির আর্কটিক সার্কলের একটি সরলরেখা আছে । রোভেনামি থেকে ৮কিমি দূরে এই ভিলেজের লাইনটি অতিক্রম করা মানেই আমরা উত্তর গোলার্ধে প্রবেশ করলাম। জানামতে, এইটাই পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে অফিসিয়ালি আর্কটিক গোলার্ধে প্রবেশ করা যায়, এবং সার্টিফিকেটও নেয়া যায়। আমরা কিছু ছবি তুলে নিলাম, কয়েকবার লাইনটির এপাশ ওপাশ করেনিলাম বন্ধুরা। এরপর দেখা করলাম ভিলেজের প্রধান, সান্তাক্লোসের সাথে। প্রায় ৯০ বছর বয়স্ক, পরিচিত সেই সাদা ধবধবে দাড়ি আর লাল পোশাকে বসে আমাদের দেখে “হ্যালো ইয়ং ফেলাস, কাম হিয়ার” বলে ডেকে নিলেন। আমরা বসলাম উনার পাশের বেঞ্চে। যখন বললেন, টেল মি ইউওর স্টোরি – আর যায় কোথায়, চয়ন শুরু করে দিলো আমাদের গল্প। আমরা কে কোথায় থাকি, কিভাবে একসাথে আজ এখানে এবং সুবর্ণযাত্রার থিম। একমনে শুনে গেলেন, আর চশমার ফাক দিয়ে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। তেমন কোনো অনুভূতি টের পেলাম না আমি উনার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু যখন কথা বলা আরম্ভ করলেন, বোঝা গেলো, সবকথা মনদিয়ে শুনেছেন উনি আর আমাদের সবাইকে একে একে কংগ্রাচুলেশন্স বললেন। “শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ” যখন বললেন – অবাক হলাম উনার উচ্চারণে। পরিবেশের জন্য আমরা এই ক্যাম্পেইন করছি, পরবর্তী প্রজন্মকে বাগান করতে উৎসাহ দিতে বলার সময় উনি আগ্রহ দেখালেন বেশ। আরো কিছু কথা হলো তারপর বিদায় আর শুভকামনা নিয়ে আমরা ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। 

আবার মতিউরের বাসায় এলাম সবাই – এবার পরিবারের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দেয়ার পালা। রিংকুর পরিবারও ছিল তখন, ওর আবার ৫ মাসের ছেলে, মায়ের কোলে। ওর চোখমুখ দেখে মনে হলো, তাই বলেই ফেললাম

“তুমি আসতে পারবে?”

– পারবো ভাইয়া, ২ দিনের জন্য ভাবীর সাথে থেকে যাবে ওরা। কিন্তু আমি আমার গাড়িটা নিয়ে যাবো, যেন নর্থক্যাপ থেকে আমি একা ফেরত চলে আসতে পারি। 

– তবে তাই হোক রিংকু, লেলিন ওকে একটা পতাকা দাও, ফোন নাম্বার, হোয়াটস্যাপ কানেক্ট করে ফেলো। ৩ গাড়ি নিয়ে আমরা রওনা দিব। 

আমার ফোন বেজে উঠলো, আলম ভাই, কানাডা? 

– হ্যালো আলম ভাই, কি খবর আপনার? 

– কেমন আছো তোমরা? নর্থক্যাপ এর পথে রওনা দিয়েছো? 

– জি ভাই, এইতো রওনা করবো এখনই। কিন্তু আপনার তো প্লেন এ থাকার কথা এখন, তাই না? আপনি বার্গেন আসছেন তো? 

– হলো না আমার আশা, মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যাচ্ছি তাই তোমাকে ফোন দিলাম

– মানে? কি বলেন?

– এয়ারপোর্টের কাউন্টার থেকে আমাকে যেতে দিলো না। নরওয়েতে এখনো কোভিড রেস্ট্রিকশন। ফ্লাই করে একান্ত ফ্যামিলি মেম্বারদের ছাড়া কারো যাওয়া ওরা এলাও করছে না। আমি অনেক করে বললাম আমার যাওয়া দরকার, প্রজেক্ট এর কথা বললাম কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। আসলে নিয়ম তো নিয়ম আর নিয়তি । 

– ওহ মাই গড । সরি আলম ভাই, কি বলবো আসলে বুঝতে পারছি না। 

– চিন্তা করোনা আমার জন্য। তোমরা যে কাজ করতে যাচ্ছ, ভালো মতো করো। আমি সাদিককে ফোন করে বলে দিচ্ছি এখন।  

কানাডায় আলম ভাই, আমার খুব শ্রদ্ধেয় আপনজন। আমি টরন্টো মুভ করার কিছুদিন পর পরিচয় হয় আমার। বয়স হলেও, মনটা খুব নরম, আর তরুণদের ভালো কাজে সবসময় উৎসাহ দিয়ে আসেন উনি। সুবার্নযাত্রার কথা বলার সাথে সাথে উনি আমাকেও উৎসাহিত করে এসেছেন। এমনকি আমাদের লোকাল এমপি নাথানিয়াল এর সাথে আলাপ করে, অফিসিয়াল লেটারের সাথে, যদি আমরা সম্পূর্ণ যাত্রা শেষ করতে পারি, তাহলে কানাডার প্রাইম মিনিস্টারের কাছ থেকে আরেকটি এচিভমেন্ট লেটার পাওয়ার প্রতিশ্রুতিও আদায় করেছেন। এই আলম ভাইয়ের ছাত্রজীবন কেটেছে নরওয়েতে। তাই উনার পরামর্শে আমরা নর্থক্যাপ থেকে বার্গেন যাওয়ার রুট প্ল্যান করি। আসলে, নর্থক্যাপ ছোট একটা শহর, এখানে বাংলাদেশী নেই। দর্শনার্থী বেশি। তাই, প্রথম কোনো কেক-কেটে বাংলাদেশের জন্মদিন উজ্জাপনটা বার্গেন এ করার পরিকল্পনা, আলম ভাইয়ের উৎসাহ আর প্ল্যানিং এর কারণেই। সাদিক ভাই আমার পয়েন্ট পারসন হলেও, আরো কিছু মানুষের কথা আলম ভাই বলেছিলেন, যারা পরবর্তীতে আমাদের অনেক সাহায্য করেছিলেন। সেই আলম ভাই আসতে পারলেন না। মনটা খারাপ হলো কিছুটা। কাউকে তখনি বলিনি বেপারটা। বার্গেনের অনুষ্ঠান ১৪তারিখ, ৩দিন সময় আছে হাতে ।  

মতিউরের মেয়েটা কান্না শুরু করে দিলো হটাৎ করেই। ভাবি শক্তহাতে ছেলেকে ধরে দাঁড়িয়ে। আমি হয়তো ধরতে পারছিলাম না, কি বয়ে যাচ্ছে ওর মনে। কাছে গিয়ে ভাবীকে বলেছিলাম – খুকু, এবার আমাদের যেতে দাও। তোমার সাথে ২০ বছর পর এসে ২ ঘন্টাও বসে গল্প করতে পারলাম না। কথা দিচ্ছি, পরেরবার আসলে বেশিদিন থাকবো, আর এই ল্যাপ্ল্যান্ডেই থাকবো। কোনো এক কটেজে আমরা সবাই বসে আড্ডা দিবো, আর চা বানিয়ে দিও তুমি। আমি খকুর জন্য আমার বাসায় বসে তৈরী করা একটা চাবির রিং নিয়ে এসেছিলাম, ওর নাম লেখা। তখনি ওকে দিলাম। আচ্ছা, আগে তো বলাই হয়নি। খুকু আর মতিউর, ২জনই আমার স্কুলের বন্ধু। আমরা একই ব্যাচ, ৯৭ এর মনিপুর স্কুল এর। একটু আধটু আলাপের পর মেয়েকে বুঝিয়ে নিয়ে খুকুরা দাঁড়িয়ে বিদায় দিলো – আর আমাদের যাত্রা আরম্ভ হলো। প্রায় ৭০০কিমি পথ, যেখানে ১৫ঘন্টা পর আমাদের লাইভ হওয়ার কথা। 

নীলা ছোট গাড়ি হওয়ার কারণে, সমতল রাস্তায় ভালো গতিতেই আগাচ্ছিলো। আর রিংকু থাকায় আমরা ২ গাড়ি পিজিওন থেকে আগে আগে চলছিলাম। বেশ কয়েকবার থেমেছি আমরা, সুন্দর কিছু ঝর্ণা, লেক, সিনিক পয়ন্টে আর বনের ধারে। ছবি তুলেছি, ভিডিও করেছি। রিংকু থাকায় আমাদের যাত্রাবিরতি গুলো হয়েছিল চোখধাঁধানো জায়গাগুলোতে। অপেক্ষা করেছি পিজিওন আসার, এলেই আবার পরবর্তী জায়গায়। ঘন্টা তিনেক পর, শুরু হলো বৃস্টি। অন্ধকার হয়ে এলো সবকিছু। আমরা ফিনল্যাণ্ড আর নরওয়ে বর্ডারের কাছে শেষ গ্যাস স্টেশনে থেকে পেট্রল নেয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। নরওয়েতে সবকিছুর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি, আর ওই গ্যাস স্টেশনেই ৩ গাড়ি একসাথে বর্ডার ক্রসিং এর প্লানছিলো। নীলা তখন আমার হাতে, লেলিন আর রক্তিম ভিডিও করায় ব্যস্ত। একটা নদীর উপর নিচু ব্রিজ পার হলাম আমি তখনি রক্তিম চেচিয়ে বললো 

– আরে, নরওয়ে? আমরা কি নরওয়ে নাকি? 

লেলিন: আরে ধুর, বর্ডার পেট্রল, পুলিশ কই? 

রক্তিম: ব্রিজ ক্রস করার পর মনে হলো ছোট করে একটা পোস্টে ‘NORGE’ লেখা দেখলাম?

আমি: হা, আমিও মনে হয় দেখলাম, কিন্তু মানে তো বুঝলাম না। আর বর্ডার হলে, এটলিস্ট একটা হলেও পুলিশ ফাঁড়ি তো থাকার কথা, তাইনা? 

রক্তিম: তোমরা হতাদিদের waze কে বিলিভ করবা না? এই দেখো বলে ওর ফোনের waze app দেখালো।

আমাদের লোকেশন এর পিছনেই, ব্রিজের উপরদিয়ে ডটেড লাইন, ২ দেশের সীমান্ত, নরওয়ে আরে ফিনল্যাণ্ড। হতাদিদ ছিল আমাদের ওয়াইফাই এর নাম, যেটার হটস্পট দিয়ে আমরা সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করতাম। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে আবারো ব্রিজ পার হলাম আমরা। চলে এলাম, বর্ডার এর এপারে আবারো, ফিনল্যান্ডের শেষ শহর কারিগসনিয়েমি। শেল গ্যাস স্টেশনে থামার কিছুক্ষনের মধ্যে বাকি ২ গাড়ি চলে এলো। চয়ন আমাদের ব্রিজ পারাপারের কাহিনী শুনে সেই কি হাসি!

– এইটা স্কান্ডেনেভিয়ান দেশরে ভাই, কোনো বর্ডার নাই আমাদের। তাই বলে ২বার ব্রিজ পার হলেন আপনারা, এইডা কি কাম করলেন। দেখেন সামনে ধরবো আপনাদের। 

মতিউর: আরে, ধরলে কেউ তো ভালোই, উনাদের সাথে আলাপ করে নিবখন। তুমি কি খালি ঘুমাইবাই বইসা বইসা আজকে? 

চয়ন: ভাই, আপনি যে সুন্দর গাড়ি চালান, আমার তো ঘুম আইসা পরে খালি।

সবাই হাহাহা করে হাসলাম, শুনশান একটা শহরের গ্যাস স্টেশনে। হা, এখানেও লোকজন থাকে। ফিনল্যান্ডের এই প্রান্তকে ল্যাপ্ল্যাণ্ড বলা হয়। আদিবাসীদের ভূমি, ওরাই বেশি থাকে আর ওদের কালচার পশ্চিমাদের থেকে অনেক ভিন্ন। এখানকার একটা ভিডিও করে লেলিন পরে ইউটুবে দিয়েছিলো; চয়নএর কথাগুলা ভিডিওতে শুনে এখনো সবাই হাসি আর মনে করি সেই রাত।

এবার নরওয়ে দেশটির রাস্তায় আমরা চললাম আরো কয়েকঘন্টা। বৃষ্টি যেন আমাদের সাথেই চলছে, যদিও নরওয়ে তে বৃষ্টি আর স্নো নিত্তনৈমন্তিক বেপার। ল্যাকসেলভ শহরে আমরা থামলাম, কিছুক্ষন পায়চারি করে রওনা করলাম আবার। এবার ৩ গাড়ি একসাথে। আমরা E69 রুটে প্রবেশ করলাম। এই রাস্তার অনেক নাম আছে তার মধ্যে ‘দা লাস্ট রোড অফ দা ওয়ার্ল্ড’ বেশি পরিচিত। এই রাস্তা অনেক বিপদজনক, সরু আঁকাবাঁকা, কখনো ঢালু আর কখনো খাড়া উপরের দিকে। এখানে একা গাড়ি নিয়ে যাওয়া বারণ। শীতকালে পুরো পথ বন্ধ থাকে। সাগরপাড়ের এই রাস্তায় অনেক বাতাস থাকে, আর হটাৎ বৃষ্টি কিংবা স্নো পথ বন্ধ করে ফেলতে পারে, তাই এই সাবধানতা। আমরা অনেক আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। বৃষ্টি র সাথে টের পাচ্ছিলাম, তাপমাত্রা যেন হটাৎ নেমে গেলো, তাই ব্ল্যাক আইস এর মতো হয়ে যাচ্ছে রাস্তার কিছু কিছু । বাজে কোনো ব্ল্যাক আইস এর উপর চাকা পড়লে গাড়ির কন্ট্রোল নিয়ন্ত্রণ করা দুষ্কর, তার উপর তীব্র বাতাস। আমি কানাডায় অনেক তুষার ঝড়ের কবলে পড়েছি, ব্ল্যাক আইস এর উপর দিয়েও গাড়ি চালিয়েছি, প্রয়োজনের তাগিদে। কিন্তু, ওই রাত্রের শেষ ২ঘন্টা আমরা সবাই চুপচাপই ছিলাম। একটু আগেও দেশ এ কথা হয়েছে, সুমন এর সাথে লন্ডন এর খবর নিয়েছি, আদনান আপডেট দিয়েছে আগামীকালকের অনুষ্ঠানের প্রিপারেশনের, ইমনের তৈরী করা ভিডিও অলরেডি ফেসবুকে পোস্ট হয়েছে, জন আর অন্তু তৈরী মিতাকে নিয়ে মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্টারভিউ নেয়ার – আরো সব কিছুই যেন সঠিক ছন্দে চলছিল। আমরাও কত বাধা পেরিয়ে সেই ঐতিহাসিক গ্লোবের দিকে যাচ্ছি। কিন্তু শেষ এই সময়টুকুর ড্রাইভ আমাদের সবকটি গাড়িতেই যেন এক নিস্তব্ধতা এনে দিয়েছিলো। কেউ তেমন কথা তো বলছিলাম না, কোনো গান ও চলছিল না। রাস্তায় এই সময় আর কোনো গাড়ি ছিল না, আমাদের ৩টি ছাড়া। মেঘ এর কারণে হয়তো তারাগুলো হারিয়ে গিয়েছিলো আর নর্দার্ন লাইট ও ছিল না। অন্ধকার পথে আমরা এগুচ্ছিলাম। যখনি মনে হচ্ছিলো এর শেষ কোথায়, রক্তিম বলে উঠলো: 

– ৫০০ মিটার পর আমাদের থামতে হবে। 

আমি: মানে কি? কেন? 

রক্তিম: আমরা তো কটেজ এসে পড়েছি। রাস্তার পড়েই কটেজ এর ঠিকানা। 

লেলিন: আর ইউ সিউর? রক্তিম: আলবৎ সিউর, এই দেখ Waze।  

আসলেই আমরা এসে পড়েছি – রাস্তার পাশে কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি নেই, কিন্তু গাড়ি থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, লাইটকে একটা ছোট বলয় ঘিরে রেখেছে। বৃষ্টিস্নাত পার্কিংলট এ আমরা ৩ টা গাড়ি পার্ক করলাম। তেমন ভালো দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু একটা সাইন দেখলাম কটেজএর নাম লেখা। আমরা তাড়াতাড়ি করে ব্যাকপ্যাক নিয়ে আগালাম সাইন দেখে। আলো তেমন একটা নেই, তাই মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে হাটছিলাম আমরা – সামনেই দেখলাম ছোট করে অ্যারো দেয়া, নিচে নামার জন্য। প্রায় ৪০/৫০ ফিট নিচে নেমে দেখলাম আমরা করেকটা ঘরে আলো জ্বলছে। আমাদের জন্য বরাদ্দ রুম ২টা খুঁজে পেলাম । একটু বাতাস আর বাতাসে ভেজা পানি এসে লাগছিলো মুখে আর শরীরে । এটা বৃষ্টি না, খেয়াল করলাম, আমাদের কটেজটা পানির উপর।

মতিউর: সাঁতার পারো তো তোমরা? ঘুমের মধ্যে পানিতে পরে গেলে কেমন হবে বেপারটা?

 রক্তিম: লাইফ জ্যাকেটটা আনা দরকার ছিল মনে হচ্ছে

লেলিন: অনেক কিছুই মনে হবে আনা হয়নি, এভাবেই চালিয়ে নিতে হবে

রক্তিম: দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে পারি আমরা নিজেদেরকে

হাহাহাহা – সবাই ঘরে ঢুকলাম। খুকুর দেয়া খাবার গরম করে খেয়ে নিলাম। আবারো যোগাযোগ হলো দেশে – কামরুল, জনদের সাথে। আর মাত্র ৬ঘন্টা । 

সকালে ঘুম ভাঙতেই শুনলাম রিংকু লেলিন কথা বলছে। জানলা দিয়া বাইরে দেখলাম, বৃস্টি নেই, কুয়াশা ঘেরা একটা লেক আর তার পর পাহাড়। বেরিয়ে এলাম জ্যাকেট পড়ে। নরওয়ের সৌন্দর্য প্রথম চাক্ষুষ করলাম । চারদিকে উঁচু পাহাড়, নিচে আমাদের লেকের উপর কটেজ। লেকের পানি এতো পরিষ্কার যে নিচের পাথর এমনকি ছোট ছোট মাছ দেখা যাচ্ছিলো। সূর্য এখনো কমলা আলো ছড়াচ্ছে, কুয়াশা আর মেঘ। লাল, সবুজ, হলুদ রং করা ছোট বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের গা গেষে। ক্যালেন্ডার এর কোনো পাতা মনে হচ্ছিলো – আহ কি অপরূপ।

মতিউর বাইরে এলো ফোনে কথা বলতে বলতে। ইশারা করলো সবাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠার। ৩০মিনিটের পথ, নর্থক্যাপের গ্লোব। প্রায় ১০মিন দূরে থাকতেই ফোনে নোটিফিকেশন এলো – “সুবর্ণযাত্রা ইজ লাইভ” – অস্ট্রেলিয়া থেকে আদনান আমাদের ফেইসবুক আরে ইউটুবে লাইভে চলে আসছে, নির্ধারিত সময়েই। ব্যাকস্টেজে এ যেয়েই শুনলাম আদনান বলছে “মতিউর কিন্তু সুবর্ণযাত্রার গাড়িটি নিয়ে অলরেডি যাত্রা শুরু করে দিয়েছে” – ওর কণ্ঠে আবেগ, নেশা, আনন্দ, বিজয় – অনেক কিছুই যেন অনুভব করলাম আমি। সবাইকে স্বাগতম জানিয়ে, লাইভ এ করা আছে, তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েই চয়নকে প্রশ্ন, 

– যার কথা আমরা কখনো শুনি নাই, তার মুখ থেকেই প্রথমে কিছু শুনি, চয়ন তুমি কিছু বলো, যাত্রা শুরু হয়ে গেছে?

– জি ভাইয়া – আসলে, আমাদের যাত্রা তো ফিজিক্যালি ৩ দিন আগে শুরু হয়েছে। ফারহানভাই কানাডা থেকে, আমি স্টোকহোম থেকে রোভেনামি এসে আজ ভোরে সবাই নর্থক্যাপের কাছে ছিলাম। এখন যাচ্ছি গ্লোবটার দিকে, আমাদের দেশ এর পতাকা উড়াতে। 

– রাস্তা দেখা যাচ্ছে, সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা। আবহাওয়া একটু গ্লুমি দেখা যাচ্ছে। শিহাব কিছু একটা বলো – তুমি তো টরন্টো থেকে আসছ। একটু শুরু থেকে বলো। কয়টা গাড়ি যাচ্ছে এখন?

– আসলে, আরেকটু পিছন থেকে আমি শুরু করতে চাই। লাইভএ অনেককেই আমি দেখতে পাচ্ছি। আরো অনেকেই আছে যারা অনেকরকম সাহায্য করছো। ইটস আণ ওনার এন্ড আমি গ্র্যাটফুল সবার প্রতি। তোমাদেরকে পাশে পেয়ে আমরা এমন একটি দুঃসাহসিক কাজ করতে পারছি। আমরা হয়তো ৩ গাড়িতে করে ৬জন এখানে সশরীরে, কিন্তু তোমরাও এই জার্নির পার্ট, তোমরাও আছো আমাদের সাথে

আদনান: হা, আমরাও এখানে সবাই একসাথে সেলিব্রেট করছি, আচ্ছা রাজিব পীরেরবাগ থেকে লাইভ, ওর কাছে যাই 

রাজীব: আমরা ২০ জন সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে এখানে আছি, কিছুক্ষন পর আমরা শহীদ বুদ্দিজীবী কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবো। সি আর ডি তোমাদের সাথে থাকতে পেরে আনন্দিত। তোমাদের সাথেই আমরা কেক কেটে আমরা রওনা দিবো। 

আদনান: ধন্যবাদ রাজীব, আমি একটু জন এর কাছে যাই – কি হচ্ছে তোমার ওখানে?

জন: আমরা এখন ঢাকার ধানমন্ডিতে। এই স্টুডিওতে আমরা ১৭জন মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সুবর্ণযাত্রার উদ্ভোদন উপলক্ষে কেক কাটবো। সারাদিন উনাদের সাথে আমরা গল্প করেছি। মিতা তুমি একটু সবার সাথে পরিচয় করে দাও। 

কথাগুলা শুনছিলাম গাড়ি চালাতে চালাতে, গ্লোবএর কাছে গেটে আমি তখন এন্ট্রি টিকেট নিলাম। মহিলা মুক্তিযোদ্ধারা একেকজন তাদের নাম পরিচয় সংক্ষেপে বলছিলেন। সুবর্ণযাত্রার জন্য শুভকামনা দিলেন। কি অদ্ভুত? একেকজন আমরা একেক দেশের নাগরিক, একেক দেশ এ থাকি আরে কিভাবে সবাই বাংলাদেশ মা এর জম্নদিন উজ্জাপনের জন্য এক হয়েছি এই সময়টায়। কি অদ্ভুত। 

প্রায় ২ঘন্টা ছিলাম আমরা সেখানটায়। নরওয়ে এর নর্থক্যাপ, যার পর আর কোনো রাস্তা নেই, আর কোনো স্থলভাগ নেই। এখানেই আমরা আইকনিক গ্লোবটায় বাংলাদেশের পতাকা লাগলাম, গল্প করলাম ভিনদেশিদের সাথে, বাংলাদেশে কেক কাটা হলো – আমাদের যাত্রা হলো শুরু। এরপর থেকে এক এক কিমি মানে আমরা এক এক পায়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এতগুলা মানুষ আমাদের সাপোর্ট করেছেন – যে যেভাবে পেরেছেন। অন্তু বললেন – “এতো দারুন যাত্রার সাথে থাকতে পেরে ভালো লাগছে। শ্রদ্ধেয় মহিলা মুক্তিযোদ্ধারাও যে আমাদের সাথে আছেন এটা খুবই ভালো লাগার বিষয়। আরেকটা কথা, শুধু এতটুকু জানি, মানি, করতে হবে – যাত্রা শুরু যখন হয়েছে, যাত্রা শেষ করতে হবে, যেকোনো মূল্যে। “

সঞ্জয় মাদারীপুর থেকে জয়েন করেছিল – বললো “এটা আমাদের জন্য একটা লাইফটাইম এচিভমেন্ট। আমি অনেক ইমোশনাল এখন। অনেক বাধা পেরিয়ে আজকে আমি গর্বিত, আনন্দিত যে আমাদের বন্ধুরা আজ ওখানটায়। আমি কৃতজ্ঞ, পরবর্তীতে প্রজন্মকে বলতে পারবো, দেশের ৫০ বছর পূর্তিতে আমরা কিছু একটা ইউনিক করতে পেরেছি।” আদনানের গলা ভেঙে গেছে ততক্ষনে, এক্সসাইটমেন্টে, আনন্দে, আবেগে। কারো কারো চোখ এ পানির ফোটাও ভিডিওতে দেখা গেলো যেন। চয়ন গাড়ির ভিতর, বাহির দেখালো। আমরা ড্রোন উড়ালাম, কিন্তু বাতাসের তীব্রতার কারণে ভালো ভিডিও করা গেলো না। 

শরীয়তপুর থেকে কামরুল – “দা ড্রিম হ্যাস কাম টু। এটা একটা টীম এফোর্ট। সবাই আমরা দিনরাত কাজ করেছি, একসাথে। আমাদের সাথে সব মানুষ, ইন্ডিভিডুয়ালি বা সংগঠনিকভাবে যারা সাহায্য করেছেন তাদের প্রত্যেককে আমরা আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ জানাই। আমি চাইবো, কখন আমার বন্ধুরা বাংলাদেশে আসবে, এবং বুকে জড়িয়ে ধরতে পারো, ওদের গল্পগুলা শুনতে পারব। ” লাইভ অনুষ্ঠানটা শেষ হয়েছিল ২দিন পর বার্গেনের লাইভের আমন্ত্রণ জানিয়ে আর কামরুলের গান দিয়ে – “দূর হয় আঁধারের রাত, আসে তোর বাড়ন্ত হাতে। বন্ধু আমায় বল, কথা ছিলি তুই। “

ওর গানটার গুন্ গুন্ করে আর কি ঘটে গেলো আজ সকালটাই – এই ভাবতে ভাবতে আমরা রওনা দিলাম – গন্তব্য বার্গেন, নরওয়ে, ২,৪০০ কিমি পথ, ২দিনে পাড়ি দেয়ার পথ। 

Quamrul Hasan Sumon

Lecturer, Department of English

Hazi Shariatullah College

Singer, Writer, Blogger

Join #Subarnajatra


An event at this magnitude, at the global level needs your help.


What we do makes a difference.

Stay Connected with #Subarnajatra

Contact: media@subarnajatra.com


Copyright © 2023 Subarnajatra. – Chinta O Chaka – All Rights Reserved